প্রাচীন জনপদের নাম বর্তমান অবস্থান
১ পুণ্ড্র বৃহত্তর বগুড়া, রাজশাহী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার অংশ বিশেষ
২ বরেন্দ্ৰ বগুড়া,পাবনা, রাজশাহী বিভাগের উত্তর পশ্চিমাংশ, রংপুর ও দিনাজপুরের কিছু অংশ
৩ বঙ্গ কুষ্টিয়া, যশোর, নদীয়া
৪ গৌড় মালদহ , মুর্শিদাবাদ,বীরভূম,বর্ধমান ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ
৫ সমতট বৃহত্তর কুমিল্লা ও নোয়াখালী অঞ্চল
৬ রাঢ় পশ্চিম বাংলার দক্ষিণাঞ্চল বর্ধমান জেলা
৭ হরকূল বা হরিকেল চট্টগ্ৰাম, পার্বত্য চট্ৰগ্ৰাম, ত্ৰিপুরা, সিলেট
৮ চন্দ্ৰদ্বীপ বরিশাল, বিক্ৰমপু্র, মুন্সীগঞ্জ জেলা ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চল
৯ সপ্তগাঁও খুলনা এবং সমুদ্ৰ তীরবর্তী অঞ্চল
১০ কামরূপ জলপাইগুড়ি, আসামের বৃহত্তর গোয়ালপাড়া জেলা,বৃহত্তর কামরূপ জেলা ১১ তাম্ৰলিপ্ত মেদিনীপুর জেলা
১২ রূহ্ম (আরাকান) কক্সবাজার, মায়ানমারের কিছু অংশ, কর্ণফুলি নদীর দক্ষিণা অঞ্চল
১৩ সূহ্ম গঙ্গা-ভাগীরথীর পশ্চিম তীরের দক্ষিণ ভূভাগ,আধুনিক মতে বর্ধমানের দক্ষিণাংশে, হুগলির বৃহদাংশ, হাওড়া এবং বীরভূম জেলা নিয়ে সূহ্ম দেশের অবস্থান ছিল
১৪ বিক্রমপুর মুন্সিগঞ্জ এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চল
১৫ বাকেরগঞ্জ বরিশাল, খুলনা, বাগেরহাট
বাংলার শাসন ব্যবস্থা
প্রাচীন বাংলার শাসন ব্যবস্থা সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণা করা খুবই কঠিন। গুপ্তপূর্ব যুগে বাংলার শাসন ব্যবস্থা কেমন ছিল তা বলা বেশ কঠিন। তবে পুন্ড্র, বঙ্গ, গৌড় প্রভৃতি উপজাতীয় নামের উল্লেখ প্রমাণ করে যে অতি প্রাচীন ব্যবস্থা সম্পর্কে কিছুটা জানা যায়। যে অঞ্চল সরাসরি কেন্দ্রীয় শাসনের অধীনে ছিল সেই অঞ্চল কতগুলি প্রশাসনিক ভাগে বিভক্ত ছিল। সর্ববৃহৎ বিভাগটির নাম ছিল ‘ভুক্তি'। ‘ভুক্তি'র অধীনে কয়েকটি ‘বিষয়' থাকত। ‘বিষয়ের' অধীনে ‘মন্ডল', ‘বীথি' ও গ্রাম থাকত। ‘ভুক্তির' প্রশাসককে ‘উপরিক' বা ‘মহারাজ উপরিকা' বলা হত। ‘বিষয়ে' শাসন কর্তাকে ‘কুমারামাত্য' বা ‘আযুক্তক' বলা হত। সময় সময় তাদেরকে ‘বিষয়পতি' বলা হত। ‘ভুক্তি', ‘বিষয়' বা ‘বীথির' শাসনকার্য পরিচালিত হত নিজ নিজ শাসন কেন্দ্রে অবস্থিত ‘অধিকরণ' এর মাধ্যমে। ‘অধিকরণ' অর্থ সরকারি কার্যালয়। বিষয়ের অধিকরণে বিষয়পতি ব্যতীত আরও চারজন সদস্য থাকত- নগর শ্রেষ্ঠী, প্রথম সার্থবাহ, প্রথম কুলিক ও প্রথম কায়স্থ। সম্ভবত নগর শ্রেষ্ঠী ছিলেন নগরের বিত্তশালী লোক। প্রথম সার্থবাহ ছিলেন বণিক সম্প্রদায়ের প্রধান; প্রথম কুলিক ছিলেন শিল্পী সম্প্রদায়ের প্রধান; প্রথম কায়স্থ বলতে হয় কায়স্থ শ্রেণীর প্রতিনিধিকে বুঝাত বা বর্তমান কালের মুখ্য সচিবকে বুঝাত। এই ৪ সদস্যবিশিষ্ট অধিকরণের উপদেষ্টা পরিষদ ও এর কার্য পরিচালনা প্রাচীন বাংলার শাসন পদ্ধতির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক।
পাল সাম্রাজ্যে অনেক সামন্ত রাজা ছিল। সামন্ত রাজাদের বিভিন্ন উপাধি পাওয়া যায়-রাজন্য রাজন্যক, রাণক, সামন্ত ও মহাসামন্ত। গুপ্ত যুগের ন্যায় পাল যুগেও ‘ভুক্তি', ‘বিষয়', ‘মন্ডল' প্রভৃতি প্রশাসনিক বিভাগের উল্লেখ পাওয়া যায়। পরবর্তী পর্যায়ে অনেকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রশাসনিক বিভাগের উল্লেখ পাওয়া যায়, যেমন ‘খন্ডল', ‘ভাগ', ‘আবৃত্তি', ‘চতুরক' ও ‘পাটক'। গ্রামের অর্ধেক অংশকে ‘পাটক' বলা হত। সম্ভবত আধুনিক পাড়ার উৎপত্তি ‘পাটক' থেকে হবে।
শাসন ব্যবস্থার কর্ণধার ছিলেন রাজা। কেন্দ্রীয় শাসনে রাজাকে সাহায্য করতেন মন্ত্রী ও আমাত্য। মন্ত্রীদের মধ্যে সম্ভবত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তা ছাড়া অনেক আমাত্য ছিল। এদের মধ্যে ‘মহাসান্ধিবিগ্রহিক' একজন পট্রধান আমাত্য ছিলেন। অপর রাজ্যের সাথে সম্বন্ধ রক্ষা করাই ছিল তার কাজ। পররাষ্ট্র বিভাগের জন্য একজন কর্মচারী ছিলেন ‘দূত'। এছাড়াও ছিল ‘রাজস্থানীয়' ও ‘অঙ্গরক্ষ', খুব সম্ভবতঃ যথাক্রমে রাজার প্রতিনিধি ও দেহরক্ষী বুঝাত। জমি করিপ সংক্রান্ত কাজে নিযুক্ত কর্মচারীদেরও নাম ছিল ‘প্রমাতৃ' ও ‘ক্ষেত্রপ'। হিসাব রক্ষণ বিভাগের প্রধান ছিলেন ‘মহাক্ষপটলিক' এবং তাকে সাহায্য করত ‘জ্যেষ্ঠ কায়স্থ'। বিচার বিভাগের কর্মকর্তা ছিলেন ‘মহাদান্ডনায়ক' বা ‘ধর্মাধিকার'। কেন্দ্রীয় শাসনে পুলিশ বিভাগ ছিল এবং ‘মহাপ্রতীহার', ‘দাম্ভিক', ‘দান্ডপাশিক' ও ‘দন্ডশক্তি' ছিল এ বিভাগের কর্মচারী। ‘মহাপ্রতীহার' রাজ প্রসাদের রক্ষণাবেক্ষণ এবং ‘খোল' নামক কর্মচারী খুব সম্ভব গুপ্তচর বিভাগের কর্মকর্তা ছিলেন।
সেনা বিভাগের প্রধান ছিলেন ‘সেনাপতি' ও ‘মহাসেনাপতি'। পদাতিক, হস্তী, উষ্ট্র, অশ্বারোহী ও রণতরী-সৈন্যদলের এই কয়টি প্রধান বিভাগ ছিল। ‘কোট্ট পাল' ছিলেন, দুর্গরক্ষক এবং ‘প্রাস্ত পাল' ছিলেন রাজ্যের সীমান্ত রক্ষক।
সেন যুগের রাজকর্মচারী ও আমাত্যদের তালিকা ছিল পাল যুগের অনুরূপ, তবে কিছু কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। যেমন ‘রাজ্ঞী' পদবটির অস্তিত্ব সেনদের তাম্র শাসনে পাওয়া যায়। ‘মহাসর্বাধিকৃত' নামে একটি উচ্চপদস্থ আমাত্যের নাম লিপিতে পাওয়া যায়। তিনি ছিলেন সম্ভবত সাধারণ প্রশাসনিক ব্যাপারে উচ্চ পর্যায়ের পরিদর্শক। এছাড়া বিচার বিভাগে ‘মহাধর্মাধ্যক্ষ'; রাজস্ব বিভাগে ‘হট্টপতি' এবং সৈন্যবিভাগে মহীপীলুপতি' ও ‘মহাবুহ্য পতি' প্রভৃতি আরও কয়েকটি নতুন পদবীর উল্লেখ পাওয়া যায়।'
এ সমস্ত পদবীর তালিকা থেকে এ কথা বলা যায় যে, গুপ্ত যুগ থেকে বাংলায় একটি বিধিদ্ধ শাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল এবং গুপ্ত যুগোত্তরকালে, বিশেষ করে পাল বংশের শাসনকালে তা সুবিন্যস্ত হয়েছিল। রাজ কর্মচারীদের তালিকা যা পাওয়া যায় তা থেকে স্পষ্ট যে বাংলায় একটি সুনিয়ন্ত্রিত ও পরিকল্পিত শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল।
স্বাধীন সুলতানী যুগে রাজদরবারে নিযুক্ত কর্মচারীদের বিভিন্ন পদবী ছিল। যেমন- হাজির, সিলাহদার, শরাবদার জামাদার ও দ্বারবান। হাজির ছিলেন দরবারের অনুষ্ঠানের কর্তা। সিলাহদার ছিলেন সুলতানের বর্ম রক্ষক; শরাবদার ছিলেন সুলতানের পত্র বাহক; এবং জামাদার পোশাকের তত্ত্বাবধান করতেন এবং দ্বারবান ছিলেন প্রাসাদের দ্বার রক্ষক। দেহ রক্ষীদের নেতাকে ছত্রী নামে অভিহিত করা হতো। সুলতানের দরবারে বহু আমাত্যদের সমাবেশ ছিল। তাদেরকে আমীর বা মালিক বলা হতো এবং তারা বিভিন্ন পদে নিযুক্ত থাকতেন।
সুলতানী আমলে বাংলার শাসনব্যবস্থায় সুলতানের পরে ছিল উজীরের স্থান। অনেক ক্ষেত্রে উজীরকে ইকলিম [প্রদেশ], আরছা [জিলা] বা শহরের শাসক হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। অনেক লিপিতে একই ব্যক্তিকে উজীর পদবীর সাথে ‘সর-ই-লস্কর' [সৈন্যাধ্যক্ষ], ‘কোতওয়াল' [নাগরাধ্যক্ষ], বা ‘শরাবদার-ই গায়র মুহল্লী' বলে অভিহিত করা হয়েছে। বাংলা সাহিত্যে উজীরের পদমর্যাদা সম্পন্ন আরও দুটি পদবীর উল্লেখ পাওয়া যায়- দবীরে খাস ও সাকের মল্লিক। দবীরে খাস ছিলেন চিঠিপত্র বিভাগের প্রধান। আর প্রধান সচিবকে বলা হতো সাকের মল্লিক।
সুলতানী যুগের সমসাময়িক শিলালিপিতে ‘সর-ই-গোমস্তা' উপাধিধারী কর্মকর্তার উল্লেখ পাওয়া যায়। গোমস্তা ভূমি রাজস্ব আদায়কারী কর্মচারী এবং তাদের প্রধানকেই ‘সর-ই-গোমস্তা' বলা হতো। বাংলা সাহিত্যে হুসেন শাহের সময় ‘অধিকারী' উপাধিধারী দু'জন হিন্দু আমাত্যের নাম পাওয়া যায় যারা সপ্ত গ্রাম মুলুকের খাজনা আদায় করত।
মুঘল আমলে বাংলার শাসন কার্যে রাজ কর্মচারীদের পদবীতে বেশ পরিবর্তন আসে। মুঘল আমলে প্রদেশ বা সুবার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন সুবাদার। তিনি নাযিম এবং সিপাহসালার নামেও অভিহিত হতেন। সুবাদার কেন্দ্রীয় উকিল ও উযীর বা প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে সম্রাট কর্তৃক নিযুক্ত হতেন।
প্রত্যেক সুবায় একজন দেওয়ান নিযুক্ত হতেন। সাম্রাজ্যের প্রধান দেওয়ানের পরামর্শে প্রাদেশিক দেওয়ান নিযুক্ত হতেন। প্রধান দেওয়ান প্রাদেশিক দেওয়ানের কার্যের তত্ত্বাবধান করতেন। প্রদেশের অর্থের দায়িত্ব প্রাদেশিক দেওয়ানের ওপর ন্যস্ত ছিল। তার অনুমোদন ব্যতীত সুবাদার প্রদেশের রাজকোষ থেকে টাকা পয়সা ব্যয় করতে পারতেন না।
প্রদেশের সামরিক বিভাগের কার্য পরিচালনার জন্য একজন বখশী নিযুক্ত হতেন। প্রাদেশিক বখশীকে কেন্দ্রের মীর বখশীর পরামর্শে নিয়োগ করা হতো। প্রদেশের জন্য ছিল সদর। তিনি সাম্রাজ্যের সদর-ই- সুদুরের পরামর্শে সম্রাট কর্তৃক নিযুক্ত হতেন। তিনি প্রদেশের ধর্মীয় বিষয়ের তত্ত্বাবধান করতেন। প্রদেশের বিচার কার্যের জন্য কাজী নিয়োগ করা হতো। বিচারকার্যে কাজীর সাহায্যের জন্য একজন মীর আদল নিযুক্ত হতেন।
বাংলার সুবা নদী প্রধান ছিল এবং সামরিক প্রয়োজনে প্রদেশে নৌবহর রাখা হতো। নৌবহরের প্রধান কর্মকর্তা ছিলেন ‘মীর বহর'। তিনি সুবাদার ও বখশীকে তার নৌশক্তি দিয়ে সাহায্য করতেন। দেশের লোকের ধর্মীয় চরিত্র ও নৈতিক জীবন তদারক ও নিয়ন্ত্রণের জন্য একজন ‘মুহতাসিব' নিযুক্ত করা হতো। অভ্যন্তরীণ শান্তি রক্ষার জন্য রাজধানী শহরে একজন কোতোয়াল বা ন্যায়পাল নিয়োগ করা হতো। তিনি ছিলেন পুলিশ বিভাগের প্রধান।
মুঘল শাসনকালে বাংলা সুবা ১৯টি সরকারে বিভক্ত ছিল। প্রত্যেক সরকারে একজন ফৌজদার নিযুক্ত হতেন। সরকারের শাসন, শান্তি রক্ষা ইত্যাদি তার দায়িত্বে ছিল। সরকারে ফৌজদার ছাড়াও আরও কয়েকজন কর্মচারী ছিল। প্রদেশে কয়েকজন ওয়াকিয়ানবীশ নিয়োগ করা হতো। তারা সুবাদার, দেওয়ান প্রভৃতি কর্মচারীদের কার্যকলাপ সম্পর্কে সবরকম তথ্য সম্রাটকে জানাতেন।
অনেকগুলো পরগনায় বিভক্ত ছিল প্রত্যেক সরকার। পরগনার প্রধান কর্মচারী ছিলেন আমিল। পরগনা ছিল প্রধানত রাজস্ব বিভাগ। তাকে অনেক ক্ষেত্রে শিকদার এবং কোন কোন সময় আমল-গুজার নামেও অভিহিত করা হতো। আমিলের কাজে সাহায্যের জন্য পরগনায় আরও কয়েকজন কর্মচারী ছিল। এদের মধ্যে আমীন, কারকুন, খাজাঞ্চি ও কানুনগো উল্লেখযোগ্য ছিলেন। আমীন মুনসেফ নামেও অভিহিত হতেন। কাজাঞ্চি খাজনাদার এবং ফোতাহদার নামেও অভিহিত হতেন। তা ছাড়া পরগনায় কয়েকজন চৌধুরী ছিলেন। চৌধুরী আধা-সরকারি কর্মচারী ছিলেন। গ্রামের রাজস্ব আদায় ও শান্তির রক্ষার ভার ছিল মুকাদ্দম বা গ্রামের প্রধান ব্যক্তির ওপরে। পাটোয়ারী গ্রামের হিসাব রক্ষার কাজ করতেন। বাংলাদেশের সুবাদার, দেওয়ান প্রভৃতি কর্মচারীরা সুশাসক ও প্রজাবৎসল ছিলেন। এর ফলে প্রজারা সুখে-শান্তিতে ছিল এবং তাদের উন্নতির পথ সুগম হয়েছিল। আমাদের দেশে বর্তমানে যেসব চৌধুরী, শিকদার, চাকলাদার, দেওয়ান, পাটোয়ারী প্রভৃতি পদবীযুক্ত বংশ পাওয়া যায়, তা ঐসব পদবী যুক্ত কর্মচারীদের অধঃস্তন পুরুষ বলে মনে হয়।
পাল সাম্রাজ্যে অনেক সামন্ত রাজা ছিল। সামন্ত রাজাদের বিভিন্ন উপাধি পাওয়া যায়-রাজন্য রাজন্যক, রাণক, সামন্ত ও মহাসামন্ত। গুপ্ত যুগের ন্যায় পাল যুগেও ‘ভুক্তি', ‘বিষয়', ‘মন্ডল' প্রভৃতি প্রশাসনিক বিভাগের উল্লেখ পাওয়া যায়। পরবর্তী পর্যায়ে অনেকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রশাসনিক বিভাগের উল্লেখ পাওয়া যায়, যেমন ‘খন্ডল', ‘ভাগ', ‘আবৃত্তি', ‘চতুরক' ও ‘পাটক'। গ্রামের অর্ধেক অংশকে ‘পাটক' বলা হত। সম্ভবত আধুনিক পাড়ার উৎপত্তি ‘পাটক' থেকে হবে।
শাসন ব্যবস্থার কর্ণধার ছিলেন রাজা। কেন্দ্রীয় শাসনে রাজাকে সাহায্য করতেন মন্ত্রী ও আমাত্য। মন্ত্রীদের মধ্যে সম্ভবত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তা ছাড়া অনেক আমাত্য ছিল। এদের মধ্যে ‘মহাসান্ধিবিগ্রহিক' একজন পট্রধান আমাত্য ছিলেন। অপর রাজ্যের সাথে সম্বন্ধ রক্ষা করাই ছিল তার কাজ। পররাষ্ট্র বিভাগের জন্য একজন কর্মচারী ছিলেন ‘দূত'। এছাড়াও ছিল ‘রাজস্থানীয়' ও ‘অঙ্গরক্ষ', খুব সম্ভবতঃ যথাক্রমে রাজার প্রতিনিধি ও দেহরক্ষী বুঝাত। জমি করিপ সংক্রান্ত কাজে নিযুক্ত কর্মচারীদেরও নাম ছিল ‘প্রমাতৃ' ও ‘ক্ষেত্রপ'। হিসাব রক্ষণ বিভাগের প্রধান ছিলেন ‘মহাক্ষপটলিক' এবং তাকে সাহায্য করত ‘জ্যেষ্ঠ কায়স্থ'। বিচার বিভাগের কর্মকর্তা ছিলেন ‘মহাদান্ডনায়ক' বা ‘ধর্মাধিকার'। কেন্দ্রীয় শাসনে পুলিশ বিভাগ ছিল এবং ‘মহাপ্রতীহার', ‘দাম্ভিক', ‘দান্ডপাশিক' ও ‘দন্ডশক্তি' ছিল এ বিভাগের কর্মচারী। ‘মহাপ্রতীহার' রাজ প্রসাদের রক্ষণাবেক্ষণ এবং ‘খোল' নামক কর্মচারী খুব সম্ভব গুপ্তচর বিভাগের কর্মকর্তা ছিলেন।
সেনা বিভাগের প্রধান ছিলেন ‘সেনাপতি' ও ‘মহাসেনাপতি'। পদাতিক, হস্তী, উষ্ট্র, অশ্বারোহী ও রণতরী-সৈন্যদলের এই কয়টি প্রধান বিভাগ ছিল। ‘কোট্ট পাল' ছিলেন, দুর্গরক্ষক এবং ‘প্রাস্ত পাল' ছিলেন রাজ্যের সীমান্ত রক্ষক।
সেন যুগের রাজকর্মচারী ও আমাত্যদের তালিকা ছিল পাল যুগের অনুরূপ, তবে কিছু কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। যেমন ‘রাজ্ঞী' পদবটির অস্তিত্ব সেনদের তাম্র শাসনে পাওয়া যায়। ‘মহাসর্বাধিকৃত' নামে একটি উচ্চপদস্থ আমাত্যের নাম লিপিতে পাওয়া যায়। তিনি ছিলেন সম্ভবত সাধারণ প্রশাসনিক ব্যাপারে উচ্চ পর্যায়ের পরিদর্শক। এছাড়া বিচার বিভাগে ‘মহাধর্মাধ্যক্ষ'; রাজস্ব বিভাগে ‘হট্টপতি' এবং সৈন্যবিভাগে মহীপীলুপতি' ও ‘মহাবুহ্য পতি' প্রভৃতি আরও কয়েকটি নতুন পদবীর উল্লেখ পাওয়া যায়।'
এ সমস্ত পদবীর তালিকা থেকে এ কথা বলা যায় যে, গুপ্ত যুগ থেকে বাংলায় একটি বিধিদ্ধ শাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল এবং গুপ্ত যুগোত্তরকালে, বিশেষ করে পাল বংশের শাসনকালে তা সুবিন্যস্ত হয়েছিল। রাজ কর্মচারীদের তালিকা যা পাওয়া যায় তা থেকে স্পষ্ট যে বাংলায় একটি সুনিয়ন্ত্রিত ও পরিকল্পিত শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল।
স্বাধীন সুলতানী যুগে রাজদরবারে নিযুক্ত কর্মচারীদের বিভিন্ন পদবী ছিল। যেমন- হাজির, সিলাহদার, শরাবদার জামাদার ও দ্বারবান। হাজির ছিলেন দরবারের অনুষ্ঠানের কর্তা। সিলাহদার ছিলেন সুলতানের বর্ম রক্ষক; শরাবদার ছিলেন সুলতানের পত্র বাহক; এবং জামাদার পোশাকের তত্ত্বাবধান করতেন এবং দ্বারবান ছিলেন প্রাসাদের দ্বার রক্ষক। দেহ রক্ষীদের নেতাকে ছত্রী নামে অভিহিত করা হতো। সুলতানের দরবারে বহু আমাত্যদের সমাবেশ ছিল। তাদেরকে আমীর বা মালিক বলা হতো এবং তারা বিভিন্ন পদে নিযুক্ত থাকতেন।
সুলতানী আমলে বাংলার শাসনব্যবস্থায় সুলতানের পরে ছিল উজীরের স্থান। অনেক ক্ষেত্রে উজীরকে ইকলিম [প্রদেশ], আরছা [জিলা] বা শহরের শাসক হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। অনেক লিপিতে একই ব্যক্তিকে উজীর পদবীর সাথে ‘সর-ই-লস্কর' [সৈন্যাধ্যক্ষ], ‘কোতওয়াল' [নাগরাধ্যক্ষ], বা ‘শরাবদার-ই গায়র মুহল্লী' বলে অভিহিত করা হয়েছে। বাংলা সাহিত্যে উজীরের পদমর্যাদা সম্পন্ন আরও দুটি পদবীর উল্লেখ পাওয়া যায়- দবীরে খাস ও সাকের মল্লিক। দবীরে খাস ছিলেন চিঠিপত্র বিভাগের প্রধান। আর প্রধান সচিবকে বলা হতো সাকের মল্লিক।
সুলতানী যুগের সমসাময়িক শিলালিপিতে ‘সর-ই-গোমস্তা' উপাধিধারী কর্মকর্তার উল্লেখ পাওয়া যায়। গোমস্তা ভূমি রাজস্ব আদায়কারী কর্মচারী এবং তাদের প্রধানকেই ‘সর-ই-গোমস্তা' বলা হতো। বাংলা সাহিত্যে হুসেন শাহের সময় ‘অধিকারী' উপাধিধারী দু'জন হিন্দু আমাত্যের নাম পাওয়া যায় যারা সপ্ত গ্রাম মুলুকের খাজনা আদায় করত।
মুঘল আমলে বাংলার শাসন কার্যে রাজ কর্মচারীদের পদবীতে বেশ পরিবর্তন আসে। মুঘল আমলে প্রদেশ বা সুবার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন সুবাদার। তিনি নাযিম এবং সিপাহসালার নামেও অভিহিত হতেন। সুবাদার কেন্দ্রীয় উকিল ও উযীর বা প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে সম্রাট কর্তৃক নিযুক্ত হতেন।
প্রত্যেক সুবায় একজন দেওয়ান নিযুক্ত হতেন। সাম্রাজ্যের প্রধান দেওয়ানের পরামর্শে প্রাদেশিক দেওয়ান নিযুক্ত হতেন। প্রধান দেওয়ান প্রাদেশিক দেওয়ানের কার্যের তত্ত্বাবধান করতেন। প্রদেশের অর্থের দায়িত্ব প্রাদেশিক দেওয়ানের ওপর ন্যস্ত ছিল। তার অনুমোদন ব্যতীত সুবাদার প্রদেশের রাজকোষ থেকে টাকা পয়সা ব্যয় করতে পারতেন না।
প্রদেশের সামরিক বিভাগের কার্য পরিচালনার জন্য একজন বখশী নিযুক্ত হতেন। প্রাদেশিক বখশীকে কেন্দ্রের মীর বখশীর পরামর্শে নিয়োগ করা হতো। প্রদেশের জন্য ছিল সদর। তিনি সাম্রাজ্যের সদর-ই- সুদুরের পরামর্শে সম্রাট কর্তৃক নিযুক্ত হতেন। তিনি প্রদেশের ধর্মীয় বিষয়ের তত্ত্বাবধান করতেন। প্রদেশের বিচার কার্যের জন্য কাজী নিয়োগ করা হতো। বিচারকার্যে কাজীর সাহায্যের জন্য একজন মীর আদল নিযুক্ত হতেন।
বাংলার সুবা নদী প্রধান ছিল এবং সামরিক প্রয়োজনে প্রদেশে নৌবহর রাখা হতো। নৌবহরের প্রধান কর্মকর্তা ছিলেন ‘মীর বহর'। তিনি সুবাদার ও বখশীকে তার নৌশক্তি দিয়ে সাহায্য করতেন। দেশের লোকের ধর্মীয় চরিত্র ও নৈতিক জীবন তদারক ও নিয়ন্ত্রণের জন্য একজন ‘মুহতাসিব' নিযুক্ত করা হতো। অভ্যন্তরীণ শান্তি রক্ষার জন্য রাজধানী শহরে একজন কোতোয়াল বা ন্যায়পাল নিয়োগ করা হতো। তিনি ছিলেন পুলিশ বিভাগের প্রধান।
মুঘল শাসনকালে বাংলা সুবা ১৯টি সরকারে বিভক্ত ছিল। প্রত্যেক সরকারে একজন ফৌজদার নিযুক্ত হতেন। সরকারের শাসন, শান্তি রক্ষা ইত্যাদি তার দায়িত্বে ছিল। সরকারে ফৌজদার ছাড়াও আরও কয়েকজন কর্মচারী ছিল। প্রদেশে কয়েকজন ওয়াকিয়ানবীশ নিয়োগ করা হতো। তারা সুবাদার, দেওয়ান প্রভৃতি কর্মচারীদের কার্যকলাপ সম্পর্কে সবরকম তথ্য সম্রাটকে জানাতেন।
অনেকগুলো পরগনায় বিভক্ত ছিল প্রত্যেক সরকার। পরগনার প্রধান কর্মচারী ছিলেন আমিল। পরগনা ছিল প্রধানত রাজস্ব বিভাগ। তাকে অনেক ক্ষেত্রে শিকদার এবং কোন কোন সময় আমল-গুজার নামেও অভিহিত করা হতো। আমিলের কাজে সাহায্যের জন্য পরগনায় আরও কয়েকজন কর্মচারী ছিল। এদের মধ্যে আমীন, কারকুন, খাজাঞ্চি ও কানুনগো উল্লেখযোগ্য ছিলেন। আমীন মুনসেফ নামেও অভিহিত হতেন। কাজাঞ্চি খাজনাদার এবং ফোতাহদার নামেও অভিহিত হতেন। তা ছাড়া পরগনায় কয়েকজন চৌধুরী ছিলেন। চৌধুরী আধা-সরকারি কর্মচারী ছিলেন। গ্রামের রাজস্ব আদায় ও শান্তির রক্ষার ভার ছিল মুকাদ্দম বা গ্রামের প্রধান ব্যক্তির ওপরে। পাটোয়ারী গ্রামের হিসাব রক্ষার কাজ করতেন। বাংলাদেশের সুবাদার, দেওয়ান প্রভৃতি কর্মচারীরা সুশাসক ও প্রজাবৎসল ছিলেন। এর ফলে প্রজারা সুখে-শান্তিতে ছিল এবং তাদের উন্নতির পথ সুগম হয়েছিল। আমাদের দেশে বর্তমানে যেসব চৌধুরী, শিকদার, চাকলাদার, দেওয়ান, পাটোয়ারী প্রভৃতি পদবীযুক্ত বংশ পাওয়া যায়, তা ঐসব পদবী যুক্ত কর্মচারীদের অধঃস্তন পুরুষ বলে মনে হয়।
No comments:
Post a Comment